শিষ্টাচার রচনা

শিষ্টাচার 

শিষ্টাচার রচনা


ভূমিকা : মানবজীবনে শিষ্টাচার অত্যন্ত মূল্যবান । ভদ্রতা , সৌজন্যেবোধ , পরিমার্জিত শ্রদ্ধা নিদর্শনকারী ব্যক্তি মাত্রই । শিষ্টাচারে গুণান্বিত ব্যক্তি বলে বিবেচিত । সে কারণেই বলতে হয় যে , কেবল শিক্ষিত বা বিদ্বান বলেই কোনো লোক সমাজে সমাদর লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না । মূলত শিষ্টাচারী লোক সর্বত্রই মহীয়ান । 

শিষ্টাচার কী : আত্মীয় - অনাত্মীয় , পরিচিত - অপরিচিত সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ , আন্তরিক ব্যবহারই শিষ্টাচার । শিষ্টাচারে সকলেই মুগ্ধ হয় । শিষ্টাচার বলতে বাইরের মার্জিত ব্যবহারই শুধু নয় , নয় ভদ্রতার সামাজিক রীতি অনুসরণ ; এর সঙ্গে যুক্ত আছে সুজনের মহৎ হৃদয়ের গভীর উষ্ণ স্পর্শ । আছে অন্তর - সৌন্দর্যের বিকশিত মহিমা । 

সামাজিক রীতি ও শিষ্টাচার : যে সমাজ যত সভ্য , তার লোকব্যবহার তত মার্জিত , সদ্ভাবমূলক এবং সুরুচিব্যঞ্জক । সেই লোকব্যবহারকে কোথাও কোথাও আন্তরিকতাহীন , বাহ্যিক রীতিমাত্র বলে ভ্রম হয় । সামাজিক অনুষ্ঠানে সৌজন্য এবং সৌষ্ঠব রক্ষার জন্য কতকগুলো সাধারণ সর্বজনীন রীতি অনুসরণ করে চলতে হয় । ভদ্রতা বাইরের আচরণীয় রীতিমাত্র নয় । রীতি শুধু বাইরের অভ্যাসমাত্র , তাতে অন্তরের স্পর্শ থাকে না । শিষ্টাচার অন্তরের বিকশিত কুসুম , হৃদয়ের অমূল্য সম্পদ । 

শিষ্টাচার লাভের উপায় : শিষ্টাচার শেখার জন্যে মানুষের অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না বরং এটা অর্জনের জন্যে প্রয়োজন একনিষ্ঠ সাধনা । শিশুকাল থেকেই একটু একটু করে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার মধ্য দিয়ে মানব শিশু শিষ্টাচারী হয়ে উঠতে পারে । দিনের পর দিন সাধনা করেই মানুষকে শিষ্টাচার অর্জন করতে হয় । সাফল্যময় জীবনের মূলে রয়েছে শিষ্টাচার । আজকের শিশুর আগামী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে শিষ্টাচারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে ।

শিষ্টাচারের গুরুত্ব : সমাজজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনেক । শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নয় , জাতীয় স্বার্থেও এর ভূমিকা অনন্য । পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে , তাদের সকল উন্নতির মূলে রয়েছে শিষ্টাচার । শিষ্টাচার দিয়ে মানুষ অতি সহজে মানুষকে জয় করে যেকোনো কাজ উদ্ধার করতে পারে । শিষ্টাচার অনুশীলিত মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদের ক্রমপুঞ্জিত যোগফল , মানুষের অন্তর সমুদ্র মন্থনজাত দুর্লভ অমৃত ফল । 

ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার : শিষ্টাচার আত্মীয়তার চেয়ে কিছু কম এবং সামাজিকতার চেয়ে কিছু বেশি । আত্মীয়তা আন্তরিক , সামাজিকতা আনুষ্ঠানিক । শিষ্টাচার উভয়ের মধ্যে সেতুস্বরূপ । তাই শিষ্টাচার লাভ করার ব্যাপারে পারিপার্শ্বিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । শিশুকাল থেকে মানুষ যে পরিবেশে বড় হয় , পরবর্তীকালে কাজে - কর্মে , আচার - আচরণে সেই পরিবেশের শিক্ষা - দীক্ষা এবং রীতি - নীতি তার চরিত্রে ফুটে ওঠে । শিষ্টাচারের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীত ও ভদ্র । নতুন প্রাণ - সম্পদে হয় গৌরবান্বিত । ছাত্রজীবনে যে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শিখল না , যার উদ্ধত - অবিনীত ব্যবহারে শিক্ষক বিরক্ত ; যার রূঢ় অমার্জিত আচরণে সহ - বন্ধুরা ক্ষুদ্ধ বেদনাহত ; পরবর্তী জীবনেও তার একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে । ছাত্রজীবনই মানুষের সুপ্ত সুকুমারবৃত্তি লালনের শুভক্ষণ । শিষ্টাচার তো তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সোপান । এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি । বিনয়ী , ভদ্র ছাত্র শুধু শিক্ষকের স্নেহই কেড়ে নেয় না , সে পায় শিক্ষকের আশীর্বাদ , পায় তাঁদের সাহচর্য । সৌজন্যে ও শিষ্টাচারের অভাব ছাত্রকে অবিনীত , স্বার্থপর , নিষ্ঠুর করে । মানবজীবনে শিষ্টাচারের স্থান : মানবজীবনের সার্বিক কল্যাণে শিষ্টাচারের স্থান অতি উচ্চে । পৃথিবীর যেকোনো মহামানবের উন্নতির মূলে রয়েছে শিষ্টাচার । শিষ্টাচার মানুষকে সমাজের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে । সামাজিক জীবনকে করে সর্বাত্মক সুন্দর । আমাদেরকে জীবনের সবক্ষেত্রে শিষ্টাচারী হতে হবে ।

শিষ্টাচারহীনতার বর্তমান চিত্র : আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রেই শিষ্টাচার সৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র দেখতে পাওয়া যায় । দিন দিন মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতা বাড়ছে । বাড়ছে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য । মানুষকে অপমান করতে পারলেই বুঝি তৃপ্তি । অবিনয় আজ আর তার লজ্জা নয় । দুর্ব্যবহার , দুমুর্খতা আর অগৌরবের নয় । দুর্বাক্য এখন বাচন - অলংকার । শিষ্টাচার ও সৌজন্যেবোধের সৌন্দর্য হারিয়ে মানুষ আজ নিঃস্ব , হৃদয়হীন ।

প্রতিকারের উপায় : আজ যদি জাতিকে নতুন প্রাণস্পন্দনে অনুপ্রাণিত করতে হয় , যদি জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় , তবে নতুন করে প্রয়োজন সৌজন্যে ও শিষ্টাচারের উদ্বোধন । গ্রহণ করতে হবে এই দুর্লভ চারিত্রিক ঐশ্বর্য আয়ত্তের শিক্ষাসূচি । গৃহ - পরিবেশ , স্কুল - কলেজ , সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান— এগুলোই হলো তার যথার্থ ক্ষেত্র । এখান থেকেই মানুষ ভবিষ্যৎ জীবনের পাঠ নেবে । এর অনুশীলনই তাকে নম্র , সুন্দর করবে । সমাজ শিষ্টাচারহীনতার কলঙ্ক থেকে বাঁচবে । 

উপসংহার : শিষ্টাচারের ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে । মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এ ক্রান্তিলগ্নে শিষ্টাচার খুবই প্রয়োজন । মানুষের সবগুণের নির্যাস হলো শিষ্টাচার । এটা কারও একার ব্যাপার নয় । শিষ্টাচার ও সৌজন্যেবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্থক হোক মানবজীবন। 

New comments are not allowed.*

Previous Post Next Post