ট্রেন বা রেলগাড়ি ভ্রমণ
সূচনা : আধুনিক সভ্যতায় দ্রুত যাতায়াত ও মালপত্র বহনের অন্যতম মাধ্যম হলো রেলগাড়ি । রেলগাড়ি কেবল নির্ধারিত রেলের উপরেই চলতে পারে । রেলগাড়ি ভ্রমণ যেমন আরামদায়ক তেমনি আনন্দদায়ক । ট্রেনে দীর্ঘ ভ্রমণের একটি চমৎকার সুযোগ আসে ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার সময় । সেবারই প্রথম রেলপথ ভ্রমণের একটা সুখ আমার ভাগ্যে ঘটেছিল।
যাত্রা শুরু : আমরা ট্রেন ছাড়ার একটু আগে গিয়েই অর্থাৎ ৮.৩০ টায় ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট আসনে বসলাম । ৯ টা বাজার সাথে সাথে রেল ছাড়ার সংকেত দেওয়া মাত্র রেল ছেড়ে দিল ।
প্রস্তুতি : আমার বাবা-মা সিলেট বেড়াতে যাবেন । সেখানে হযরত শাহজালাল ( র ) ও শাহপরান ( র ) -এর মাজার জিয়ারত করবেন । আমাদের পরিবারের চয় জন সদস্য সিলেট যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলাম । সময়টি ছিল ডিসেম্বরের শেষে । বার্ষিক পরীক্ষা মাত্র শেষ হলো । এ সুযোগে আমি সিলেট ঘুরে আসতে পারব বলে খুব আনন্দিত হলাম । আমরা হালকা বিছানাপত্র আর পথে কিছু খাওয়ার জন্যে কলা , কমলা ,মাল্টা, আপেল ও রুটি সাথে নিলাম । বাসা থেকে বের হয়ে রিকশাযোগে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলাম ।বাবা স্টেশন হতে ‘ উপবনের ' চয়টি টিকেট আনলেন ।
বর্ণনা : নির্দিষ্ট আসন । বাড়তি যাত্রীর বিরক্তিকর ভিড় নেই । বেশ খোলামেলা গাড়ি । গাড়ির একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত যাতায়াত করা যায় । গাড়িতে খাবার ব্যবস্থা আছে । কামরার ভেতর জানালার পাশের সিটটি আমার ছিল । কাজেই বাইরের দৃশ্য সহজেই দেখতে পেলাম । সকালের সোনালি রোদ দু পাশে ঝলমল করছে । গাড়ি ছুটছে অনবরত ঝিক ঝাক শব্দ করে । আমাদের কামরার বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ব্যস্ত । কেউ কেউ কৌতুক করতে লাগল , কেউ গল্প করতে লাগল , আবার কেউ চা পান করছে । ফেরিওয়ালা বাদাম বাদাম বলে আহ্বান করছে । বিভিন্ন জেলার যাত্রী আমাদের কামরায় উঠেছে । তাই তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল । পরস্পরের কথা শোনা ও বলার আসরটা ছিল খুবই আনন্দদায়ক । আমি বসেছিলাম গাড়ির ডান পাশে । চমৎকার আলো এসে পড়ছে । সকালে গ্রামের জীবন হয়ে উঠেছে কর্মচঞ্চল । বিচিত্র মানুষের কর্মপ্রবাহ চকিতের জন্যে চোখে পড়ছে । আবার মুহূর্তে যাচ্ছে পেছনে ছুটে । ভালো করে দেখার আগেই কত মধুর দৃশ্য হারিয়ে গেল । তবু বেশ ভালো লাগছে । বেলা এগারোটায় এসে পৌছলাম আখাউড়া জংশনে । এখানে এসে ট্রেনের ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয় এবং সেখান থেকে সিলেটের লাইনে যাওয়া যায় । আখাউড়া পৌছে আমরা হালকা নাস্তা করলাম । আমার বড় ভাই ট্রেন সম্পর্কে । অনেক কিছু জানাল । আমাদের ট্রেনটি আবার ছুটে চলল । জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম । বাইরের গাছগাছড়া সব কিছুই দ্রুত উল্টো দিকে ছুটে চলছে । তাই মনে হল জগতের কিছুই স্থির নেই , সব কিছুই চলমান । ট্রেনটি বনের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলছে । বিরামহীন গতি । যেন কেউ তাকে বাঁধা দিচ্ছে না । ট্রেনের মধ্যে আমরা চা পান করলাম । আমাদের পথ ধরে চলতে লাগল । রাস্তার দু পাশেই চা বাগান । আমার কাছে বাগানগুলোকে মনে হচ্ছে পাহাড় হতে সিঁড়ি কাটা হয়েছে । মাঠঘাট , বাড়িঘর , মিল - কারখানা , চা বাগান , বন , পাহাড় সব বিদ্যুৎ গতিতে বিপরীত দিকে ছুটে চলেছে । ট্রেনের মধ্যে এক গায়ক একতারা বাজিয়ে আমাদেরকে গান গেয়ে শোনাল । গান শেষে সবাই এক টাকা - দুই টাকা করে লোকটির পাওনা পরিশোধ করল ।
গন্তব্যস্থানে অবতরণ : আমরা বিকাল ৪ টায় সিলেট পৌছলাম । গাড়ি আস্তে আস্তে স্টেশনে থামল । কুলিদের হাঁকডাকে আমাদের চমক ভাঙল । আমরা ট্রেন থেকে নেমে ধীরে ধীরে বহির্গমন পথের দিকে চলতে লাগলাম । এখানেই ট্রেন ভ্রমণের সমাপ্তি ।
উপসংহার : রেলগাড়ি ভ্রমণ সত্যিই মনে আনন্দ আনে । দীর্ঘ যাত্রাপথের জন্যে এটি অত্যন্ত ভালো । যাত্রাপথে বিচিত্র মানুষের সাথে দেখা হয় এবং ভ্রমণ পথের বিভিন্ন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয় । তাই রেলগাড়ি ভ্রমণ করে সেদিন আমি যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা কোনোদিন ভুলতে পারব না ।