আমাদের গ্রাম
সূচনা : শিশু যেমন তার মায়ের কোলকেই বেশি সুখদায়ক মনে করে , আমাদের গ্রামটিও আমার কাছে তেমনই মনে হয় । আমি এখানে জন্মেছি। গ্রাম আমার ভালোবাসা। সেখানে মুগ্ধ বাতাস আমাকে বড় হতে সাহায্য করেছে । এর ছায়াঘেরা মায়াময় কোলে আমার চঞ্চল জীবন কাটাচ্ছি । এর নদীর পানি আমার তৃষ্ণা দূর করছে । এর খেতের ফসল আমার ক্ষুধা দূর করছে । নানা রঙের পাখি গান শুনিয়ে আমার ঘুম ভাঙাচ্ছে । এর বাতাসে আমি শ্বাস গ্রহণ করে বড় হয়ে উঠছি । এ গ্রামের মানুষের কাছে আমি পেয়েছি আদর , স্নেহ ও ভালোবাসা । তাই আমার গ্রামকে আমি মন - প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি ।
অবস্থান : ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার ২ নং মির্জাপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত আমাদের গ্রামটির নাম পরিজপুর । খুলনা - কুষ্টিয়া মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বেই অবস্থিত গ্রামটি । এটি শৈলকুপা উপজেলা অঞ্চলের উত্তরাংশের শেষ প্রান্তে একটি ক্ষুদ্র জনপদ । এটির পশ্চিমে যোগিপাড়া , পূর্বে মির্জাপুর এবং উত্তরদিকে পদমদী গ্রাম ।
আয়তন ও অধিবাসী : আমাদের গ্রামের আয়তন দৈর্ঘ্যে প্রায় এক কিলোমিটার ও প্রস্থে আধা কিলোমিটার থেকে কিছু কম । আমাদের গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চয় হাজার । এই গ্রামে হিন্দু মুসলমান,বৌদ্ধ একত্রে বসবাস করে । গ্রামের অনেক বাড়িতে উচ্চশিক্ষিত লোক আছেন । তাঁরা ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ভালো চাকরি করেন । গ্রামে বয়স্ক লোকেরা সবাই কোনো না কোনো ব্যবসা কিংবা কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করেন । অন্যান্য পেশার লোকও আছে । তাঁদের মধ্যে শিক্ষক , উকিল , ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , জেলে , কামার , কুমার , সুতার উল্লেখযোগ্য । গ্রামের অধিকাংশ লোক শিক্ষিত ।
ঘরবাড়ি : আমাদের গ্রামের অধিবাসীদের বাড়িঘর প্রধানত টিনের তৈরি । গ্রামে বিশটি পাকা বাড়ি এবং উচু কিছু দালান আছে । এখানে ছনের বা খড়ের ঘর নেই বললেই চলে । কয়েকটি বাশের বা ভেড়ার ঘর আছে।
গ্রামের উৎপন্ন দ্রব্য সমূহ : গ্রামের প্রধান উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে ধান , পাট , গম , ডাল , সরিষা , তিল , তামাক , ইক্ষু এবং বিভিন্ন রকম শাকসবজি উল্লেখযোগ্য । পুকুর , নদী ও খালে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় । হাঁস - মুরগি প্রচুর ডিম দেয় । গাভীর দুধ পাওয়া যায় । বাগানে আম , জাম , কলা , নারিকেল , সুপারি , তাল , পেয়ারা , বেল প্রভৃতি ফল প্রচুর উৎপন্ন হয় । এককথায় গ্রামের মানুষের খাবারের জন্যে যা প্রয়োজন তার প্রায় সবই উৎপন্ন হয় ।
গ্রামের প্রতিষ্ঠান সমূহ : আমদের গ্রামে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় , একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা আছে । গাঁয়ের ছেলে - মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম পাঠ শুরু করে এবং এখানে পড়া শেষ করে হাই স্কুলে ভর্তি হয় । সন্ধ্যার পর চৌধুরিবাড়ির বৈঠকখানায় বয়স্ক লোকদের লেখাপড়ার আসর বসে । গাঁয়ের কয়েকজন শিক্ষিত যুবক তাঁদের লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন । তাই আমাদের গ্রামে কোনো নিরক্ষর নেই । নদীর পারে নতুন বাজারে পোস্ট অফিস , টেলিগ্রাম , দাতব্য চিকিৎসালয় , কৃষি অফিস আছে ।
যোগাযোগ ব্যবস্থা : ইউনিয়ন পরিষদের আধাপাকা সড়কটি আমাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে খুলনা কুষ্টিয়া মহাসড়কে ও শৈলকুপা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত । এই আধাপাকা সড়কই গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা সব ঋতুতেই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ।
হাটবাজার : আমাদের গ্রামে একটি ভালো বাজার আছে । বাজারটি বেশ বড় । বাজারটি সপ্তাহে দু বার বসে । তা ছাড়া দৈনিক সকালে বাজার বসে । মাছ , দুধ , তরকারি ও দৈনন্দিন প্রয়োজনের প্রায় সব জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায় । হাটের দিনে বহুদূর থেকে ক্রেতা - বিক্রেতা আসে । হাটের দিন এখানে ধান , চাল , হাঁস - মুরগি প্রভৃতি সব রকমের জিনিসপত্র বেচাকেনা হয় । বাজারে বিশজন স্থায়ী দোকানদার আছে । তাদের দোকান ভোর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে । মোটের ওপর গ্রামের লোকেরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাববোধ করে না ।
গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য : ‘ অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তবে পদধূলি , ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি । ' সত্যিই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশের গ্রামের সুন্দর বর্ণনা সার্থক হয়েছে আমাদের গ্রামখানির ক্ষেত্রে । মনে হয় যেন প্রকৃতির আপন খেয়ালে এ গ্রামটি সাজানো । মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাবৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের গ্রামখানি । যেদিকে চোখ যায় , সেদিকে দেখা যায় আম , জাম , কাঁঠাল , বেল , কুল , পেয়ারা এবং আরও নানারকমের গাছ । মাঠভরা ধান ও অন্যান্য শস্যখেতের ওপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায় তখন খুবই সুন্দর দেখায় ।
উপসংহার : এমন একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে আমি ধন্য । সর্বদাই সাধ জাগে , যেকোনো মূল্যে গ্রামের ঐতিহ্য বজায় রাখব , উন্নয়নে তৎপর হব এবং সর্বপ্রকার কুপ্রভাব থেকে গ্রামটি মুক্ত রাখব ।